![]() |
শীতের সকাল রচনা |
শীতের সকাল
অনুরূপ রচনা :
* একটি শীতের সকাল [সি. বো. ০৫; চ. বো. ০৫]
রচনা সংকেত:
ভূমিকা, শীতের সকালের রূপ বর্ণনা, নগর ও গ্রামীণ জীবনে এর বৈচিত্র্য, শীতের সকালের বিশেষ আকর্ষণ, ব্যক্তিগত অনুভূতি, উপসংহার।
ভূমিকা :
একটি দিনের শুরু হয় সকাল দিয়ে। একটি সকাল একটি দিনের সূচনা। দিনের এ লগ্নটি ঋতুভেদে বিচিত্র রূপ নিয়ে আসে মানুষের জীবনে। ষড়ঋতুর দেশ আমাদের এ বাংলাদেশ। পৌষ ও মাঘ— এ দু মাস শীতকাল। শীতের আগমনের সাথে সাথে কাননে, পত্রে পুঞ্জে, জলে-স্থলে সর্বত্রই একটা পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা যায়। স্নিগ্ধ শীতের সকাল আবির্ভূত হয় এক ব্যতিক্রমধর্মী সৌন্দর্যের ও মাধুর্যের রূপ নিয়ে। বনে বনে পাখিদের হৃদয়ে তার গোপন সংবাদ সবার অলক্ষ্যে ছড়িয়ে পড়ে তাদের মধুর কণ্ঠ ও আনন্দ রাগিণী। কুয়াশা ও শিশিরসিক্ত প্রকৃতি সহসা দূর করে স্বল্পকালের মধ্যে শীতের সকাল এক অপরূপ সূর্যের কাঁচা আলোতে ঝলমল করে ওঠে— যা নিজ চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না। শীতের সকাল আসে কুয়াশার আবরণে আবৃত হয়ে। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে অনন্য হয়েই সে নগর আর গ্রামীণ জীবনে ধরা দেয়।
শীতের সকালের রূপ বর্ণনা :
অন্যান্য ঋতুর তুলনায় শীতের সকাল বৈচিত্র্যপূর্ণ। প্রকৃতির পালা বদলের হাওয়ায় শীত আসে রিক্ততা আর শূন্যতার ডালি নিয়ে। ফসলহীন মাঠ, পাতাঝরা শূন্য গাছ দেখে মনে হয় প্রকৃতি যেন বৈরাগ্যের বসন পড়েছে। শীতের সকাল পাতলা কুয়াশার চাদর পড়ে আরও বিষণ্ন করে তোলে পরিবেশ। সূর্যের দেখা পাওয়া যায় না। যতদূর চোখ যায় শুধুই অন্ধকার। লেপ-কাঁথা থেকে উঠি উঠি করেও মন চায় না শীতের সকালে বিছানা থেকে উঠতে। শিয়রে হিংস্র শীত কেশর ফুলিয়ে থাবা পেতে বসে আছে। শীতের সকালের জড়তা তাই সবার চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কর্মের আহ্বান সত্ত্বেও এক অথর্ব অলসতা মানুষকে শয্যায় ধরে রাখে। কনকনে শীতে বুড়ো বুড়িরা কুয়াশায় কম্বল বা কাঁথা গায়ে দিয়ে আগুন পোহাবার জন্য শুকনো পাতা কুড়াতে বনের ভেতর দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে চলতে থাকে, বনের পাখি উড়াউড়ি করে এ গাছে ও গাছে। তাদের কলকাকলী লেপের নিচের মানুষগুলোকে জানিয়ে দেয় আলো ঝলমলে সকালের বার্তা। আস্তে আস্তে কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে সূর্যিমামা অফুরন্ত মিষ্টি আলো ছড়াতে ছড়াতে উকি মেরে ওঠে। উত্তরের হিমেল হাওয়া বইতে থাকে ধীরে ধীরে। চালের ওপর গাছের শাখা থেকে টুপ টুপ করে পড়তে থাকে শিশির। শিশির ভেজা দুর্বাঘাসে বা টিনের চালে সূর্যের কাঁচা রোদ পড়লে মনে হয় মণিমুক্তা জ্বলজ্বল করছে। রোদে ডানা ভিজিয়ে পাখিরা গানের জলসা বসায় প্রকৃতির মুক্তাঙ্গনে। সর্ষের হলুদ ফুলে সাতরঙা প্রজাপতি রঙের বাহার ছড়ায়। গাঁদা, ডালিয়া, সূর্যমুখী, চন্দ্রমল্লিকা ফুলের ঝকঝকে হাসিতে উদাসী সকালের মুখে হাসি ফোটে। সূর্যালোক কুয়াশার জাল ছিঁড়ে ফেলার পর প্রকৃতি ধারণ করে ভিন্ন মূর্তি। আস্তে আস্তে লেপ-কাঁথা ছেড়ে বেরিয়ে আসে মানুষ। ধীরে ধীরে কর্মমুখরতায় কর্মব্যস্ত হয়ে ওঠে শীতের সকাল।
নগর ও গ্রামীণ জীবনে এর বৈচিত্র্য:
নগর ও গ্রামীণ জীবনে শীতের সকালে বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। গ্রামের অধিকাংশ মানুষই কৃষক। শীতের সকালেই তাদের বেরিয়ে পড়তে হয় জীবনের তাগিদে। তাই শীতের কষ্টকে তুচ্ছ করে কুয়াশার মধ্যেই তারা মাঠের দিকে রওয়ানা হয়। কেউ কেউ আবার সূর্য ওঠার প্রতীক্ষায় থাকে। কখন রোদের উষ্ণতা গায়ে মেখে ফসল কেটে আনবে সে প্রতীক্ষা করে। শীতকালই ইরি ধান লাগাবার উপযুক্ত সময়। এ সময় গ্রামের কৃষকেরা হাল চাষের উদ্দেশ্যে বের হয়। কনকনে শীতের মধ্যেও তাদের পানিতে হাল চাষ করতে হয়। এ সময় ইরি ধান লাগানোর দৃশ্য দেখতে ভালো লাগে। শীতের সকালের রোদে কৃষাণ-কৃষাণী তাদের মৌসুমি শস্য ঘরে তোলার জন্য কর্মব্যস্ত থাকে। ভোর হলেই তারা একবার শাক-সবৃদ্ধি বা বাগান ক্ষেতে দর্শন দেয়। কৃষাণী ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার দিনের প্রয়োজনীয় কাজে। এ সময় গ্রামের অনেকে খড়কুটো দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে চারপাশে বসে উত্তাপ নেয়। গ্রামের বধূরা এ সময় নানা রকম পিঠে তৈরি করে, পাশাপাশি চলে হালকা গল্প-গুজব। আর শীতের সকালে গাছ থেকে নামানো খেজুর রসের আবেদন তো একেবারেই আলাদা। ছোট শিশুরা ঘুম ঘুম চোখে উঠে আসে। তাদের শরীরে প্যাঁচানো থাকে বড় চাদর। গুটি গুটি পায়ে তারাও এসে বসে চুলোর পাশে। এক সময় গাছের ফাঁক দিয়ে উকি দেয় সূর্য। যেখানেই রোদ দেখা যায় সেখানেই ছুটে যায় গ্রামের মানুষগুলো। রোদে বসে মনের আনন্দে মুড়ি খায়। শীতের সকালে পিঠে খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। শীতকাল উপভোগের ঋতু। এ সময় বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে সবজি পাওয়া যায়। শীতকালীন ছুটির কারণে ছেলেমেয়েদের থাকে অফুরন্ত অবসর। তারা সবাই খেলা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। গাছের পাতায় শিশিরের শেষ বিন্দুটুকু শুকিয়ে যাবার আগে হঠাৎ মুক্তোর মতো ঝলসে উঠে। বাতাসে ভেসে বেড়ায় পিঠে-পায়েসের মিষ্টি ঘ্রাণ। সোনালি ফসল বোঝাই গরুর গাড়ি গাঁয়ের আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ধরে এগিয়ে যায়। কৃষকের মনে দারুণ আনন্দ। কৃষকের গোলা ভরে যায় সোনালি ধানে।
গ্রামের চেয়ে শহরে শীতের দাপট কম। শহরে সাধারণত দু’শ্রেণির লোক দেখা যায়। একশ্রেণির লোক অতি আরামে সময়াতিপাত করে, আর একশ্রেণি রয়েছে যারা ছেঁড়া কাঁথা বা ছেঁড়া কাপড়ে শরীর আবৃত করে বসে থাকে। কেউ বা সামান্য খড়কুটো জ্বালিয়ে গরম করে হাত-পা। শহুরে জীবনে শীতের সকাল হুট করেই চলে যায়। উঁচু তলায় যাদের বসবাস তাদের কাছে শীত সকালের কোন আবেদন নেই বললেই চলে। ইটের তৈরি বাসভবনে শীতের সকাল উপভোগ করা যায় না। অফিসমুখী লোকজন বেরুবার একটু আগেই বিছানা ছাড়ে। হাত মুখ ধুয়ে চা কিংবা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজে চোখ বুলায়। এর পরই কর্মব্যস্ততায় ডুবে যায়। কিন্তু শহরেও শীত নামে, কুয়াশাঘেরা শীতের সকাল আসে। থাকে না কেবল শিশিরভেজা মেঠোপথ, কাঁচা রস, পিঠেপুলি আর ভাটিয়ালি সুর। শহরে শীতের সকালে কুয়াশায় অনেক সময় বাড়িঘর, পথঘাট আচ্ছন্ন হয়ে যায়। দিন মজুরেরা এ সকালেই কাজের আশায় বের হয়। রাস্তার পাশে বিক্রি হয় ভাপা পিঠে। খুব সকালে রাস্তায় যানবাহন কম চলে। ঘন কুয়াশার মধ্যে হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি চলতে দেখা যায়। নার্সারি, বাড়ির লন কিংবা ছাদের টবে গাঁদা, ডালিয়া, কসমস ইত্যাদি শীতের ফুল ফোটে। স্বাস্থ্য সচেতন লোকেরা প্রাতঃকালীন ভ্রমণে বের হয়। ফুটপাত, বাস টার্মিনাল, রেলওয়ে স্টেশনে ছিন্নমূল, ভাসমান মানুষের দল তখনও ঘুমিয়ে থাকে। একসময় কুয়াশা কেটে রোদ ওঠে। ছিন্নমূল মানুষের কষ্ট তখন কিছুটা হলেও লাঘব হয়। বাজারে শাক-সবজির ব্যবসায়ীরা পণ্য সম্ভার সাজিয়ে বসে খুব সকালে। লুচি, পরোটার গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরা হাত দেয় সংসারের কাজে, কর্তা থলি নিয়ে রওনা হন বাজারের উদ্দেশ্যে।
শীতের সকাল নগর ও গ্রামীণ জীবনে কিছুটা ভিন্নতা নিয়ে হাজির হয়। গ্রামের অধিকাংশ মানুষই দরিদ্র। তারা শীতের পোশাকের অভাবে অনেক কষ্ট সহ্য করে। শহরেও অনেক গরিব মানুষ রয়েছে। গ্রামের তুলনায় শহরে শীত কম। গ্রাম আর শহরভেদে শীত ভিন্ন আমেজে মানুষের মনের আঙ্গিনায় ধরা দেয়। তবে, গ্রামের প্রকৃতিতে শীত তার আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল থাকে।
শীতের সকালের বিশেষ আকর্ষণ :
শীতের সকালে সকল মানুষই তাদের সঙ্গতি অনুযায়ী গরম কাপড় পরে থাকে। চাদর, সোয়েটার, টুপি, মোজা, মাপলার, জ্যাকেট ইত্যাদি নানা পোশাক সামর্থবান মানুষেরা পরে শীত নিবারণ করে। অপেক্ষাকৃত দরিদ্র মানুষেরা কম কাপড় পরেই শীত নিবারণ করার চেষ্টা করে। তবে শীতের বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে খেজুরের রস ও রসের পায়েস। তাছাড়া নানা রকম পিঠা, পুলি খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। শীতের সকালে খালি পেটে খেজুরের ঠাণ্ডা রস খেতে জুড়ি নেই। সুফিয়া কামাল তাঁর কবিতায় ছোটবেলার শীতকে স্মরণ করেছেন এভাবে –
“পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসে খুশিতে বিষম খেয়ে আরও উল্লাস পড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি খেয়ে। কুলের কাঁটার আঘাত সহিয়া কাঁচা পাকা কুল খেয়ে অমৃতের স্বাদ যেন লভিয়াছি গাঁয়ের দুলালী মেয়ে।”
ব্যক্তিগত অনুভূতি :
শীত অনেকের কাছেই প্রিয় ঋতু। ভালো খাওয়া-দাওয়ার জন্য এ ঋতুর তুলনা হয় না। শীতকালে আমাদের দেশে বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে। ফলে, চলাফেরায় অনেক সুবিধে হয়। গ্রামের মেঠোপথ ধরে চলার পরিপূর্ণ আনন্দ লাভ করা যায় শীতের সকালে। শীতের সকালে কাজের চাপ থেকে দূরে থেকে মানুষ একান্তে আনন্দ উপভোগ করে। এমন অবসন্ন কুয়াশা কিংবা মায়াময় নরম রোদের আমেজ আর কি কখনও আমরা পাই? শীতের সকালে মানবহৃদয়ে কিসের যেন শূন্যতা লক্ষ করা যায়। এ সময় মন চায় কারো সান্নিধ্য লাভ করতে। শীতের সকালের স্থায়িত্ব ক্ষণিকের। অল্প সময়ের জন্য এসে মানুষের মনে তার পরশ বুলিয়ে যায়, রেখে যায় কোমল স্পর্শ।
উপসংহার :
শীতের সকাল আপন বৈশিষ্ট্যে আবির্ভূত হয় বাংলাদেশের প্রকৃতিতে। কুয়াশার পর্দা পরে আমাদের সামনে হাজির হয় শীতের সকাল। গরম পোশাকের অভাব আর পাতাঝরা গাছের মলিনতা থাকলেও, ঘরভরা সোনার ফসলের পূর্ণতা মানুষের মনে অনাবিল শান্তি আনয়ন করে। আমাদেরই একটা শ্রেণি আরাম-আয়েশে শীতের সকাল অতিবাহিত করে। তারা যদি গরিব-দুঃখীদের প্রতি সাহায্যের হাত প্রসারিত করে, তাহলে আমরা সবাই মিলে আনন্দের সাথে শীতের সকাল উপভোগ করতে পারি। শীতের সকালের প্রকৃত অবস্থা, সৌন্দর্য ও মাধুর্য পেতে হলে শহর ছেড়ে গ্রামে যেতে হবে, কারণ গ্রামীণ পরিবেশেই এর বৈশিষ্ট্য অধিকমাত্রায় পরিলক্ষিত হয়।